বগুড়া থেকে শ্যামলী বাসে উঠেছি। গন্তব্য কক্সবাজার। বহুদিন পর যাচ্ছি। তবে ভীড় বেশি হওয়ায় চেয়ার কোচ এ সিট পাই নি। বসেছি বাঙ্কারে। আমার সাথে আরো দুজন সহযাত্রী এই বাঙ্কারে বসে আছে। আমাকে বলা হয়েছে রাস্তার মাঝে কোন সিট খালি হলেই আমায় চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হবে। এ নিয়ে অবশ্য দুশ্চিন্তা করছি না। বউ, ছেলে মেয়ে, বাবা- মা বসতে পেরেছে এটাই বেশি। অনেক দিন পর এই শীতে একটা জম্পেশ আড্ডা হবে সমুদ্র তীরে সবাই মিলে। সিলেট থেকে যোগ দিতে আসছে আমার ছোট ভাই। সব মিলিয়ে এতো বেশি আনন্দ আর উত্তেজনা বিরাজ করছে যে সিট নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই।
বাস ছাড়লো রাত ৮ টার দিকে। ড্রাইভিং যিনি করছেন তার আনুমানিক বয়স ৩৫-৩৮। পোড় খাওয়া চেহারা। অত্যধিক ধূমপান করে বোধ হয়। ভেবেছি পথিমধ্যে ড্রাইভার এর সাথে আড্ডা দিতে দিতে যাওয়া যাবে। রাস্তা-ঘাট ও কিছু চিনে রাখবো। রাতের রাস্তার অন্যরকম সৌন্দর্য উপভোগ করবো। কিন্তু ড্রাইভারকে দেখে বয়সের তুলনায় বড্ড বেশি গম্ভীর লাগছে। হয়তো এই গাম্ভীর্য ধরে না রাখলে অন্ধকারের বুক চিরে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাওয়া যাবে না!
খেয়াল করলাম কিছুক্ষণ পরপরই ড্রাইভার এর ফোনে কল আসছে। উনি ৩০-৪০ সেকেন্ড কথা বলার পর ফোন রেখে দিচ্ছেন। সিরাজগঞ্জের ফুড ভিলেজ আসার আগ পর্যন্ত উনি প্রায় ১০-১২ বার ফোন রিসিভ করেছেন। আমার পাশে বসা একজন সহযাত্রী বলে উঠলেন,
– ঐ মিয়া, এতো কথা বলো ক্যান ফোনে ড্রাইভিং এর সময়? এজন্যই তো এতো দুর্ঘটনা ঘটে। ফোন রেখে ভালো ভাবে গাড়ি চালাও। নিজের জানের ডর নাই দেইখ্যা কারো জানের নাই?
ড্রাইভার একবার তাকিয়ে কিছু না বলে ড্রাইভিং চালিয়ে যেতে লাগলো। আমি নীরবে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছিলাম৷ এর ঘন্টাখানেক পর আবার উনার ফোন বাজছিলো। উনি রিসিভ করছিলেন না। পরপর চারবার বাজার পর কল ধরলেন উনি। মিনিট তিনেক কথা বললেন। এরপর ফোনটা দেখলাম সুইচড অফ করে রাখলেন।
এসময় আগের যাত্রী আবার বলে উঠলেন,
” কথা কী কানে যায় না? ফাইজলামি করেন এত্তগুলা প্রানের সাথে? এতো কথা গাড়ি চালানোর সময় বলতে হবে কেনো?”
ড্রাইভার তাকিয়ে খুব শান্ত স্বরে বললো, ” দুঃখিত, ভাইজান।”
আমার একটু অবাক লাগলো। আমি সাধারণত ড্রাইভারদের এতো কোমল কন্ঠস্বর শুনি নি। যাই হোক, আমি আমার পরিবারের সাথে দেখা করতে গেলাম। এরপর আবার নিজের আসনে এসে কোনরকমে চোখ বন্ধ করলাম। এরমধ্যে ভোর ৬ টায় আমরা চট্টগ্রাম অতিক্রম করেছি। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এরপর পৌঁছে যাবে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে।
সকাল হতেই মনটা ফুরফুরে লাগছে। কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে শুনছি পছন্দের গান। ড্রাইভার কে দেখলাম আগের মতোই থমথমে মুখে ড্রাইভ করছে। কোন দিকে তাকাচ্ছে না। আর কোন ফোনকলে কথাও বলেন নি তিনি। ১০ঃ ৩০ টার দিকে পৌঁছে গেলাম প্রিয় বালুকাবেলায়।
বাস থেকে নামার পর অপেক্ষা করছি মালামাল গুলো বুঝে নিতে। এরই মধ্যে বাস ড্রাইভারকে দেখলাম নিচে নেমে বোতলের পানি দিয়ে মুখ ধুচ্ছে। সারা রাতের ক্লান্তি যেনো এক লহমায় দূর করতে চাচ্ছে। আমি কাছে গেলাম উনার। কেনো জানি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কোন কারণে আপনার মন কী খারাপ?
উনি আমার দিকে চেয়ে আবার মুখ ধোয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন। ১০ সেকেন্ড পর বললেন,
” না ভাই, মন খারাপ করে আর কী হবে? গত রাতে আমার মা মারা গেছে। হাসপাতালে ছিলো। মনে হয় মাটি দিতে পারবো না। কী কপাল! কাল রাতে মারা যাবার কথা শুনেই ফোন বন্ধ করে দিছি। আরো পরে খুলবো।”
আমি চমকে উঠলাম। কী অবলীলায় তিনি বলে যাচ্ছেন তার প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা! এতো সহজে এতো কঠিন কথা বলা যায়! শুধু বললাম, ড্রাইভিং এর দায়িত্ব টা অন্য কাউকে দেয়া যেতো না?
আবার বলতে শুরু করেছেন তিনি।
“বুঝলেন ভাই, খুব কষ্ট কইরা মায়ে মানুষ করছে আমারে।” একটু থেমে আবার বললো,
“আমি ইচ্ছা করলে আর একজনরে দিয়া গাড়ি চালায় নিতে পারতাম। কিন্তু ঐ যে দায়িত্ব! এর জন্যই আমি নিজেই গাড়ি চালাইছি। আমার যে হেল্পার সেও গাড়ি চালাতে পারে, কিন্তু এখনো শিখতেছে। মা তো আর ফিরে আসবে না কিন্তু এতোগুলো মানুষের জীবন আমার হাতে। আপনাদের নিরাপদে পৌঁছে দেয়া আমার কর্তব্য। ঠিকঠাক মতো আপনাদের নামায় দিছি। আমার দায়িত্ব শ্যাষ।”
বলেই লোকটা হনহন করে বড়ো বড়ো পা ফেলে কোথায় যেনো চলে গেলো।
আমি মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, সে বারবার ফোনে কথা বললো বিধায় মনে মনে কতো কী না ভেবেছি! কিন্তু সে যে কী পরিমাণ মনোকষ্টে ছিলো তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। আসলে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো খুব সহজ কিন্তু বিচার করা খুব কঠিন।
সমাপ্ত
( বিঃদ্রঃ এই গল্পের বিপরীতে অনেক গল্প আছে, অনেক কথা আছে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই গল্পটা জীবনের খুব ক্ষুদ্র অংশের একটি ঘটনা। আমি ড্রাইভার এর কথা বলার পক্ষে সাফাই গাইছি না। সড়ক দুর্ঘটনা অনেক সময় মোবাইলে কথা বলার জন্যও ঘটে। নিরাপদে থাকুক সবাই।)