রেলওয়ে : ভারতের লাইফ লাইন | কৌশিক রায়

ভারতের ‘লাইফ লাইন’ তথা ভারতীয় রেলওয়ে সম্পর্কে তিনটি চমকপ্রদ তথ্য দিলাম। তথ্যগুলি ভবিষ্যতের নয়, আজকেরও নয়, একেবারে নিখাদ অতীতের। ভাল লাগলে আরও দেব।

তথ্য এক

দেশের মধ্যে আমাদের এই তল্লাটে (হাওড়া থেকে হুগলি) সবচেয়ে আগে রেলপথ তৈরি করা হলেও ভারতের প্রথম রেলযাত্রার শিরোপা পায় মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেলযাত্রাটি। সেটা ছিল ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল। অথচ কথা ছিল, হাওড়া থেকে হুগলীর পথেই প্রথম ট্রেন চলবে। শেষপর্যন্ত সেই ট্রেন চলল ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট। ঘোষিত প্রথম রেলযাত্রার প্রায় ১৬ মাস বাদে। কিন্তু কেন এই বিলম্ব? মূলত নিচের কারণগুলির জন্যই আমাদের পশ্চিমবঙ্গ প্রথম রেলযাত্রার বিরল সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।

  • ফরাসিদের দখলে থাকা চন্দননগরের ওপর দিয়ে ব্রিটিশ নির্মিত ও পরিচালিত ট্রেন যাতায়াতের ব্যাপারে অনুমতি পেতে দেরি হয়েছিল
  • লণ্ডনে তৈরি হওয়া ইঞ্জিনটি জাহাজে করে কলকাতা আসার পথে ভুলক্রমে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়
  • দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে ডায়মণ্ডহারবারের কাছে ‘এইচ এম ভি গুডউইন’ জাহাজটি ডুবে যায়। এই জাহাজেই ছিল ট্রেনটির জন্য প্রয়োজনীয় কামরা। জাহাজডুবির সঙ্গে সঙ্গে প্রথম রেলযাত্রার পরিকল্পনাটিরও সলিল সমাধি ঘটে। পরবর্তীকালে অবশ্য স্থানীয়ভাবে কামরাগুলি বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

তথ্য দুই

১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট হাওড়া থেকে হুগলি রেল যাত্রার কিছুদিনের মধ্যেই রেল লাইন রানিগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সে সময় উৎসাহীদের সংখ্যা খুব একটা কম ছিল না। তাঁরা শুধু দর্শন নয়, আরোহণেও আগ্রহ দেখাতে থাকলেন।

প্রথম প্রথম ভয় পেলেও ধীরে ধীরে তাই যাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই সময় রেলযাত্রীদের সুবিধার কথা ভেবে অক্ষয়কুমার দত্ত একটি কুড়ি পাতার বই লিখে ফেলেছিলেন। সেই বইতে /যাত্রীদের নানা উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। আখ্যাপত্রে লেখা ছিল:

“DIRECTIONS for A RAILWAY TRAVELLER

বাস্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ অর্থাৎ যাঁহারা কলের গাড়ি আরোহন করিয়া গমন করিবেন, তাঁহাদের তৎসংক্রান্ত বিঘ্ন নিবারণের উপায় প্রদর্শন

শ্রী অক্ষয়কুমার দত্ত প্রণীত কলিকাতা তত্ত্ববোধিনী যন্ত্রালয়ে মুদ্রিত

১৭৭৬ শকাব্দ মাঘ মাস”।

সময়-সারণি ও ভাড়ার বিবরণ ছিল বইটির একেবারে শেষে, পরিশিষ্টে। দূরত্ব দেওয়া ছিল মাইলে। হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ যেতে মোট সময় লাগত ৬ ঘন্টা। মধ্যবর্তী ১২১ মাইলের মধ্যে ছিল ১৮টি স্টেশন। বইটিতে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণীর ভাড়ার পরিমান দেওযা ছিল। আর ভাড়ার বিন্যাস ছিল এক পিঠ ও উভয় পিঠের।

তথ্য তিন

শুধু রেলকে কেন্দ্র করে একটা গোটা উপন্যাস! ভাবা যায়? তাও আবার সেটা লেখা হয়েছিল সেই ১৮৯৮ সালে এবং বাংলায়। বইটির নাম? ‘রেলওয়ে চরিত’। গোটা উপন্যাসটির বিভিন্ন অধ্যায়ের নামকরণেও ছিল চমক। টিকিট-বাবু পর্ব, লাগেজ-বাবু পর্ব, মাল-বাবু পর্ব, স্টেশন-মাস্টার পর্ব বা বড়-বাবু পর্ব, জমাদার-বাবু পর্ব ইত্যাদি নামগুলি আদতে ছিল রেল-বিভাগের বিভিন্ন চরিত্রের নামে। লেখকের নাম দেওয়া হয় নি, পরিবর্তে লেখা আছে– ‘কোন বহুদর্শী রেলওয়ে কর্ম্মচারী প্রণীত ও প্রকাশিত’। বইটি পিতৃব্য রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তাই উৎসর্গ-পত্র থেকে লেখকের পদবী সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় মাত্র।

গোটা উপন্যাসটি, বিশেষ করে তার তার-বাবু পর্ব পাঠ করলে বোঝা যায় লেখক সত্যিই ‘বহুদর্শী রেলওয়ে কর্মচারী’ ছিলেন কারণ রেল কর্মযজ্ঞের সম্যক ধারণা না থাকলে অমনটা লেখা যায় না। বইটি থেকে সামান্য উদ্ধৃতি –

“… সেই গবাক্ষের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, টিকিট-বাবু একখানা টুলের উপর বসিয়া আছেন। সম্মুখে একখানি শত-ছিদ্র-বিশিষ্ট আম্রকাষ্ঠের টেবিলের উপর একটি ক্ষুদ্র আলমারি। তাহার ভিতর শ্রেণীবদ্ধ করিয়া, টিকিটগুলি স্তরে স্তরে সজ্জিত রহিয়াছে। সর্র্বনিম্নের টিকিটখানি, কালী ঠাকুরের জিহ্বার মত, কোটর হইতে অর্দ্ধেক বহির্গত হইয়া আছে। অথবা শীঘ্রই গৃহত্যাগ করিতে হইবে ভাবিয়া, যাত্রা করিয়া বসিয়া আছে। … বাম-পার্শ্বে চৈত্র-পূজার সঙের ন্যায় একটি লৌহ নির্মিত যন্ত্র। সেই যন্ত্র দ্বারা টিকিটে তারিখ দেওয়া হয়।” সত্যি লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তির তারিফ করতেই হয়।

স্বাতী চক্রবর্তীর দাবিতে আরও একটি তথ্য সংযোজিত হল

তথ্য চার

১৮৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এক সৌম্য, অভিজাত ব্যক্তি তাঁর দশ-এগারো বছরের শান্ত, দীর্ঘকায় ও স্বাস্হ্যবান সন্তানকে নিয়ে হাওড়া থেকে বোলপুরগামী ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে উঠে বসলেন। বালকটির তখনও বারো বছর পূর্ণ হয়নি বলে রেলের নিয়মমতো ভদ্রলোক ছেলের জন্য অর্ধেক (হাফ) টিকিট কেটেছিলেন। ছেলেটিকে দেখলে মনেই হয় না তার বয়স বারো বছরেরও কম। আসলে বয়সের চেয়ে তার বৃদ্ধি কিছুটা বেশিই হয়েছিল। বালকটিরর সেই প্রথম ট্রেন যাত্রা। চোখে মুখে অসীম বিস্ময় নিয়ে সে সব কিছু নিরীক্ষণ করে যাচ্ছিল।

কোনও একটি বড় স্টেশনে গাড়ি থেমেছে। টিকিট পরীক্ষক টিকিট পরীক্ষা করে ছেলেটির মুখের দিকে কিছুক্ষণ দেখলেন। কিছু একটা সন্দেহ করলেও মুখে কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পরে তিনি আরও একজনকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। উভয়ে গাড়ির দরজার কাছে উসখুস করে আবার চলে গেল। তিনবারের বার সম্ভবত স্বয়ং স্টেশন মাস্টার এসে হাজির হল। ছেলেটির হাফ টিকিট পরীক্ষা করে তিনি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই ছেলেটির বয়স কি বারো বছরের অধিক নহে।’ ভদ্রলোক স্থিতধী স্বভাবের, বাক-বিতণ্ডা পছন্দ করেন না। তাই বিনীতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে তাঁর ছেলের বয়স বারো বছরের বেশি নয়, বরং অনেকটাই কম। কিন্তু স্টেশন মাস্টার তা মানতে রাজি নন, তিনি বলে বসলেন, ‘ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।’ ক্রুদ্ধ ভদ্রলোকের দুই চোখ জ্বলে উঠল। কথা না বাড়িয়ে তিনি বাক্স থেকে তখনই নোট বের করে দিলেন। হিসেব করে দাম কেটে নিয়ে বাকি টাকা ফেরত দিতে আসলে তিনি সেই টাকা মুঠোয় করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। প্ল্যাটফর্মের মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তা ঝনঝন করে শব্দ করে উঠল। স্টেশম মাস্টার অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। আসলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পয়সা ছুঁড়ে ফেলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, অন্তত পয়সা বাঁচাবার জন্য ছেলের বয়স গোপন করেননি। আর সেই কিশোর যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

কৃতজ্ঞতা– ছবির জন্য গুগল

Share this article
0
Share
Shareable URL
Prev Post

জন্ম নিবন্ধন সংশোধন: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পদ্ধতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Read next
0
Share