- আলোচক: হিমাদ্রি শর্মা
- বইয়ের নাম: বসন্ত বিলাপ
- লেখক: হুমায়ূন আহমেদ
- বইয়ের ধরন: রচনা সংকলন ও সমগ্র
- প্রচ্ছদশিল্পীর নাম: কাইয়ুম চৌধুরী
- প্রকাশকাল: কার্তিক ১৪১৯, নভেম্বর ২০১২
- প্রকাশনীর নাম ও ঠিকানা: প্রথমা প্রকাশন। সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫, বাংলাদেশ।
- পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৫৯
- মূল্য: ২৬০ টাকা
- ISBN: 9789849019244
‘ছোটবেলায় কোন লেখকের বই সবচেয়ে বেশি পড়া হয়েছে?”— প্রশ্নটি যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তবে সবিনয়ে এর উত্তর দিতে চাই-“হুমায়ূন আহমেদ”।
শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, এই উত্তরটা অধিকাংশের সাথেই মিলে যাবে। এভাবেই এই জেনারেশন এবং পরবর্তী জেনারেশনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে যাবে হুমায়ূন আহমেদের লেখা। তাঁর সৃষ্টি ‘হিমু’ কিংবা ‘মিসির আলি’ সিরিজগুলো আগামী কয়েক দশক পরও সমানতালে জনপ্রিয়তা পাবে পাঠক মহলে। লেখক হিসেবে সবসময়ই অনবদ্য সাহিত্য জগতের এই সম্রাট।
‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সাথে হুমায়ূন আহমেদের অনেক অনেক স্মৃতি। এই পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকেই হুমায়ূন নিয়মিত লেখালেখি করতেন এখানে। “বসন্ত বিলাপ” বইটি মূলত প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া হুমায়ূন আহমেদের লেখা সমগ্র নিয়ে রচিত। এক বিশাল পাঠক শ্রেণি প্রথম আলো সংগ্রহই করতেন সেখানে হুমায়ূনের লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়ার জন্য। সে রকম ২৫টি ছোট আয়তনের গদ্য রচনা, ২টি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে এই বইয়ে।
এছাড়াও প্রথম আলোয় প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের ৮টি সাক্ষাৎকার রয়েছে এ সংকলনে। এসব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের নিজের জীবনের অদ্ভুত সব গল্প, বিশ্বাস, লেখালেখি সম্পর্কে নানান কথা, উঠে এসেছে সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সম্পর্কে হুমায়ূনের নানান দৃষ্টিভঙ্গি। বইয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে তাঁর বিখ্যাত চরিত্র ‘হিমু’ এবং ‘মিসির আলি’ নিয়ে তাঁর বেশ খোলাখুলি কিছু কথাবার্তা। সবকিছু মিলিয়ে “বসন্ত বিলাপ” বইটি পাঠককে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে হরেক রকম মজার-মজার তথ্য জানাবে, জানাবে উনার স্মৃতিবিজড়িত কিছু মুহূর্তের কথা। এই বইটি পড়ার মাধ্যমে হুমায়ূন পাঠকরা নতুন করে নতুনভাবে আবিষ্কার করবে লেখক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কে।
বইয়ের প্রারম্ভেই রাজনীতি-সমাজ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বেশকিছু লেখা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে পিলখানা হত্যাখান্ড নিয়ে তাঁর ‘মানব এবং দানব’-শিরোনামের লেখাটা উপস্থাপিত হয়েছে। যেখানে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন সেই ভয়াবহ দিনের। তিনি সেদিন বাসায় বসে টিভিতে বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছেলের আহাজারি দেখছিলেন। আর মনের গভীরে ক্ষত অনুভব করছিলেন। সেই প্রসঙ্গে লিখতে যেয়ে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন—“আমার খুব ইচ্ছে করে পিতৃহারা সন্তানদের পাশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করি। তাদের পিঠে হাত রেখে বলি, এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে, এই দিনেরে নিবে সেই দিনের কাছে।”
তাছাড়া হুমায়ূন আহমেদের সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে কিছু লেখাও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তেমনই একটি লেখা ছিল ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ’- শিরোনামের একটি লেখা। এখানে তিনি কাহিনীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন কিভাবে দেশের একজন মন্ত্রী সেই দেশের কোনো বড় দুর্ঘটনার দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেন। এখানে লেখক গল্পের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা উপহাস করার চেষ্টায় ছিলেন। এই উপহাস করাটা যেন অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ও বাঞ্ছনীয়। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অধ্যাপক ইউনূস’কে নিয়ে তাঁর লেখা উঠে এসেছে বইটিতে। সেখানে অধ্যাপককে নিয়ে তিনি কিছুটা স্মৃতিচারণ করেন—“অধ্যাপক ইউনূসকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কখনো দেখাও হয়নি তাঁর সঙ্গে। তবে তাঁর কাজে আমি মুগ্ধ হই বারংবার। তাই নিজের লেখা একটি বইয়ের উৎসর্গপত্রে তাঁর নামটা আমি জুড়ে দিয়েছি। যেদিন এই ভদ্রলোক বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে দিয়ে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলেন, আমার এখনো স্পষ্টত মনে পড়ে সেদিন আমি আমার টিমকে নিয়ে নাটকের শুটিং এ ব্যস্ত ছিলাম। হঠাৎ একজন সহকর্মী এসে যখন এই খুশির সংবাদটি দেয় আমাদের, সাথে সাথেই পুরো টিম মিলে উৎসবে মেতে উঠি। শুটিং ক্যানসেল করে দিয়েছিলাম আমি। রাত জুড়ে পার্টি করে উদযাপন করেছি বিশেষ এই দিনটিকে মনে রাখবার জন্য।” আর এই সম্মানিত ব্যক্তি যখন তাঁর দেশের মানুষের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান পান না, তখন সেটা হুমায়ূন আহমেদকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তবুও সগৌরবে হুমায়ূন আহমেদ বলেন,“আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই অধ্যাপক ইউনূসের পেছনে থাকব এবং প্রার্থনা করব, যাতে তাঁর মাথার ওপরের ঘন কালো মেঘ সরে গিয়ে সূর্যকিরণ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।”
এছাড়া “বসন্ত বিলাপ” বইয়ে উঠে এসেছে লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণমূলক চারটি লেখা। তিনি ক্রিকেট খুব একটা ভালো বুঝতেন না, তবুও বাংলাদেশের টাইগারদের উৎসাহ জোগানের জন্য বারবার সস্ত্রীক ছুটে যেতেন ক্রিকেট মাঠে। বাংলাদেশের খেলার দিন সহকর্মীদেরকে নিয়ে বাসায় খেলা দেখতেন প্রায়ই। বিজয় উল্লাসে মেতে উঠতেন সবার সাথে। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর অনেক মজার স্মৃতি উঠে এসেছে এই বইয়ে। তাঁর বানানো চলচ্চিত্রের গল্প, নাটকের কতশত স্মৃতি এগুলো রয়েছে এই বইয়ে। নানান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আহমদ ছফা, জাহানারা ইমাম) নিয়ে তাঁর অনুভূতিমূলক লেখাগুলো স্থান পেয়েছে এই বইটিতে।
‘সাক্ষাৎকার’ অংশে প্রথম আলোর একাধিক সাংবাদিক হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে তাঁর জীবনের অনেক গল্পই বের করার চেষ্টা করেছেন। কখনো তারা জানতে চেয়েছেন তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে, কখনো আবার হিমু কিংবা মিছির আলি নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন। কিংবা পাঠকদের প্রতি তাঁর ভাবনার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে তাঁর কাছ থেকে। তাঁর বড় বড় সৃষ্টিকর্মগুলো নিয়ে কথা বলেছেন তারা। সর্বমোট আটটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে। মোটামুটি সবগুলো পড়লে একজন পাঠক হিসেবে আপনি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অনেক জানা তথ্যের পাশাপাশি অজানা তথ্যও জানতে সক্ষম হবেন।
“বসন্ত বিলাপ” বইটি হুমায়ূন পাঠকের কাছে অনন্য একটি গ্রন্থ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাঁর অনন্য রসবোধ ও অনুপম রচনাশৈলী বইয়ের প্রতিটি রচনাকে পাঠকের কাছে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলবে। সাক্ষাৎকারগুলো পড়লে মনে হয় বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গিসহ একজন সম্পূর্ণ হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন।
বসন্ত বিলাপ | হুমায়ূন আহমেদ
বসন্ত বিলাপ | হুমায়ূন আহমেদ-
বসন্ত বিলাপ | হুমায়ূন আহমেদ | বুক রিভিউ | হিমাদ্রি শর্মা9/10 Amazingআলোচক:- হিমাদ্রি শর্মা বইয়ের নাম: বসন্ত বিলাপ লেখক: হুমায়ূন আহমেদ ধরন: রচনা সংকলন ও সমগ্র প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী প্রকাশকাল: কার্তিক ১৪১৯, নভেম্বর ২০১২