“বই এবং দরজা একই জিনিস, আপনি সেগুলো খুলুন এবং আপনি অন্য জগতে চলে যাবেন।”
~জিনেট উইন্টারসন
◾বইটি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত:
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। নিজ দেশের মধ্যে এতো মনোরম ও সুন্দর একটি সৈকত যা দেখতে ভীড় জমায় বিদেশি পর্যটক সহ্ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা। স্বচক্ষে অবলোকন করতে কেউ কেউ বহু প্রতীক্ষার পর ছুটে যায় সেই সমুদ্র সৈকতের পানে। কেমন হয় যদি বইয়ের পাতায় গল্পে গল্পে কক্সবাজারের জীবনচিত্র গুলো জানতে পারেন? অর্থ কিংবা বিভিন্ন কারণে হয়তোবা অনেকেরই সমুদ্র দেখাটা স্বপ্নের মতো মনেহয় তাদের জন্য আমার মতে মনেহয় কম খরচে ও ঘরে বসেই বইয়ের পাতায় জানতে পারেন “মেরিন ড্রাইভ” বইটির মাধ্যমে কক্সবাজারের মানুষ ও ঐখানের জীবনপ্রণালি সম্পর্কে।
“মেরিন ড্রাইভ” লেখক রেজাউল ইসলাম আজিম রচিত একটি গল্পগ্রন্থ যাতে ঠাঁই পেয়েছে কক্সবাজারের বিভিন্ন ধারার চিত্রপট ও গল্পে গল্পে লেখক জানান দিতে চেয়েছেন কক্সবাজার মানুষের ভাষা,সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের ঐ কথা। যাকে বলে একের ভেতর সব।
◾প্রচ্ছদ কথন:
প্রবাদে আছে,আগে দর্শনধারী পরে গুনবিচারী। এদিক দিয়ে বলতে গেলে বলা যায়,দর্শনের দিক দিয়ে সবার প্রথমে প্রচ্ছদটি নজর কাড়বে সকলের। হলুদ রঙের ছাপা অক্ষরে “মেরিন ড্রাইভ” শব্দটিকে সুসজ্জিত করা হয় ও বইয়ের কভার পেইজে মেরিন ড্রাইভ রাস্তার ছবিটা বেশ সুন্দরভাবে প্রদর্শিত করা হয়। সবমিলিয়ে বলতে গেলে বলাই যায় এদিক দিয়ে প্রচ্ছদ শিল্পী বেশ সার্থক বইটির নামকরণের সাথে মিল রেখে প্রচ্ছদটি সাজাতে।
◾গল্পগ্রন্থের সূচিপত্র:
“মেরিন ড্রাইভ” বইটিতে লেখক মোট ১৩ টি গল্পের সমন্বয়ে সাজিয়েছেন বইটি। গল্পগুলো কক্সবাজারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে বেশ সহায়ক। তাহলে নিচে গল্পগুলো কি কি দেখে নেওয়া যাক:
১।আদিনাথ দর্শন
২।কক্স সাহেবের বাড়ি
৩।কাঁকড়া পয়েন্ট
৪।গোদমারি
৫।ছয় নম্বর ঘাট
৬।দরিয়ানগর গুহা
৭।নাজিরার টেক
৮।পালের দোকান
৯।মেরিন ড্রাইভ
১০।ম্যানেস্টেট
১১।রাংকুট নগরী
১২।লবণ খেত
১৩।সেন্টনার্টিন ইত্যাদি
বইয়ে থাকা সবগুলো গল্প আমার কাছে সেরা মনে হয়েছিল কেননা সবগুলো গল্পে লেখক শিক্ষণীয় জিনিস ও জানার আগ্রহ লুকিয়ে রেখেছেন। যে বিষয়গুলো আমরা কখনো শুনিনি কিংবা দেখা ত দূরে চিন্তা ও করিনি সে বিষয়গুলো লেখক গল্পে গল্পে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন বেশ নিখুঁতভাবে।
আমার সবচেয়ে ভালোলাগা কিছু গল্পের সারাংশ সবার সামনে উপস্থাপন করলাম:
◾গল্প ০১- আদিনাথ দর্শন:
লেখক এই গল্পে আদিনাথ দর্শন এর নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। মহেশখালী হয়ে কীভাবে আদিনাথ দর্শন মন্দির ও মহেশখালীর সৌন্দর্যের পাশাপাশি কক্সবাজারের রাস্তাঘাটের কোনদিক দিয়ে কোনদিকে যেতে হয় বা আদিনাথ দর্শনে যাওয়ার সময় লেখক তার সাথে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা গুলো শেয়ার করেছেন বেশ সাবলীলভাবে। এমনকি আদিনাথ মন্দিরের পাশে সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় উঠা এরপর কক্সবাজারের গাড়ি টমটম কিংবা অটোরিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও এসেছে গল্পে। লেখক দেখিয়েছেন আদিনাথ মন্দিরের ইতিহাস ও এর আশেপাশের পারিপার্শ্বিক দিকগুলো।
◾গল্প ০২- কক্স সাহেবের বাড়ি:
কক্সবাজার নামটা সবাই আমরা জানি বা চিনি। কিন্তু এর নামকরণের ইতিহাস কি আমাদের সবার জানা? হয়তোবা হাতেগোনা কয়েকজন পাওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে আমি নিজেও অবাক হলাম কক্স সাহেবের বাড়ি গল্পটির মাধ্যমে কক্সবাজারের নামকরণের ইতিহাস জেনে। লেখক এ গল্পে কীভাবে ও কি কি উপায়ে কক্সবাজার নামকরণটি হলো তার বর্ণনা বিশেষ করে এই গল্পে লেখক কক্স সাহেবের বাড়ি পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বলেছেন। কক্স সাহেবের বাড়ি পরিদর্শন করে লেখক হতাশ হওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন কেননা ঐখানে লেখক যা দেখতে…….
◾গল্প ০৩- গোদমারি:
কোনো এক অভিনেতা বলেছিলেন, “এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি।” এই গল্পেও হয়েছে তাই কক্সবাজার এর আঞ্চলিক ভাষায় যখন গোদমারি শব্দটা ব্যবহার করা হয় তখন আমাদের কাছে এটা শুনতে খারাপ বা গালি মনেহয়। কেননা,একেক অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা একেক রকম আর কক্সবাজারের জেলেরা ও এই গোদমারি শব্দটা কালের বিবর্তনে ব্যবহার করে আসছে। কীভাবে একটা শব্দ থেকে কালের বিবর্তনে আরেকটা শব্দে রূপ নেয় তাই গল্পটির সার্থকতা। যদিও লেখক গল্পে বিষয়টা পরিস্কার করেছেন। নামকরণটা শুনে প্রথমত গালি মনে হওয়ারই কথা কিন্তু এর পেছনে থাকা নামকরণ জানতে হলে অবশ্যই গল্পটি পড়তে হবে।
◾গল্প ০৪- ছয় নম্বর ঘাট:
কক্সবাজার এর ঝাউতলা তিনরাস্তার মোড়ে যখন টমটম ওয়ালাদের মুখে ঘাঢত ঘাঢত শব্দটা বহুল ব্যবহৃত বুলি। সেখানে আমাদের কাছে শব্দটা বেশ অপরিচিত ই মনে হবে। ঘাঢত অর্থ হচ্ছে ঘাট। যাকে তারা আঞ্চলিক ভাষায় বলে ঘাঢত। তেমনি ছয় নম্বর ঘাটের পেছনেও লুকিয়ে আছে বহু ইতিহাস। কালের বিবর্তনে যে এখনো এই ছয় নম্বর ঘাটটি টিকে আছে এটাই লেখক দেখিয়েছেন। ছয় নম্বর ঘাটের রহস্য ও এর পেছনে থাকা ইতিহাস লেখক গল্পে উপস্থাপন করেছেন সুন্দর ভাষায়। পাশাপাশি আমরা আরো দেখতে ঘাটটি নিয়ে মানুষের মনে রাখার বিষয়টিকে ঘিরে এই ঘাটটি এখনো যেন প্রাণবন্ত। তবে কি লেখক ছয় নম্বর ঘাটের পেছনে থাকা ইতিহাসটি পুরোপুরি জানাতে পেরেছিলেন…..
◾গল্প ০৫- মেরিন ড্রাইভ:
পৃথিবী এক অপূর্ব সৌন্দর্যের নিদর্শন। এখানে আল্লাহর সৃষ্টির সবকিছুই বেশ সুন্দর। তবে একেক দেশের কিছু কিছু পর্যটন কেন্দ্র আছে যেগুলোতে আমরা দেখতে পাই আল্লাহর সৃষ্টি ঠিক কতোটা নিখুঁত হতে পারে। ঠিক তেমনি মেরিন ড্রাইভ সড়কটি হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য্যের এক প্রাণবন্ত স্থান। মেরিন ড্রাইভ সড়কের মনোরম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক এই গল্পে। লেখক এই গল্পটিতে মেরিন ড্রাইভ সড়কের চারপাশের দৃশ্য ও এটি তৈরির পেছনে কাদের অবদান সবকিছুর যৌক্তিক আলোচনা করেছেন। স্বচক্ষে না দেখেও কেবলমাত্র লিখা পড়েই মেরিন ড্রাইভ সড়কের প্রেমে পড়তে আপনিও বাধ্য। কতো সুন্দর আমাদের এই ধরণী! মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি বলে কথা, কি দারুণ বর্ণনায় লেখক সাজিয়েছেন মেরিন ড্রাইভ সড়কের……….
◾গল্প ০৬- রাংকুট নগরী:
গল্পের নামটা শুনে প্রথমত অবাক হচ্ছিলাম কারণ নামটা প্রথমবার শুনেছিলাম তাই। এই গল্পটিতে রাংকুট নগরীর প্রাচীন ঐতিহ্য আমাদের আজ-ও যেন পরিচয় করিয়ে দেয় সেই বৌদ্ধ বিহার সহ্ গৌতম বুদ্ধের অসংখ্য তৈরি নিদর্শন সমূহ সম্পর্কে। গল্পে লেখক রাংকুট নগরী নামকরণটি কীভাবে হয়েছে ও একে রামকোট নামেও যে মানুষজন চিনে তার বর্ণনা দিয়েছেন। রাংকুট নগরী যাতায়াতের মাধ্যম ও এর প্রতিষ্ঠাকাল,পূর্ব নাম,ঐতিহ্য, স্থাপনা সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবমিলিয়ে বলতে গেলে অতীত ইতিহাস জানতে পেরে পাঠে অনেকটা মুগ্ধতা পেলাম। এর ভেতরে থাকা অতীত স্থাপনাকে লেখক প্রাণবন্ত করেছেন তার সাহিত্যিক ভাষায়……..
◾গল্প ০৭- সেন্টমার্টিন
“সেন্ট মার্টিন” নামটা সকলের কাছেই বহুল আলোচিত ও পরিচিত একটি নাম। কক্সবাজার গেলে সেন্টনার্টিন যা যাওয়াটা অনেকের কাছেই বৃথা মনেহয়। আর তা হওয়ারই কথা। সেন্টনার্টিন যে একটি কক্সবাজার লীলাভূমির অপরূপ সৌন্দর্য্যের স্থান। লেখক এই গল্পটাকে দীর্ঘায়িত করে সেন্টমার্টিন যাওয়ার অভিজ্ঞতা গুলোকে আমাদের জন্য তুলে ধরেছেন ও ভীষণ শিক্ষণীয় কিছু দিক তুলে ধরেছেন। জাহাজঘাট থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিনে থাকা সামগ্রিক দিকের বর্ণনা লেখক গল্পে পরিস্কার করেছেন। বেশি অবাক হয়েছিলাম যখন শুনলাম সেখানে হুমায়ুন আহমেদের একটি “সমুদ্র বিলাস” নামক বাড়ি ছিল। সে বাড়িটির সৌন্দর্য ও লেখক দেখিয়েছেন। সবমিলিয়ে বলতে গেলে সেন্টমার্টিন এর নামকরণ,পারিপার্শ্বিক অবস্থা সহ্ যেন এর রূপরহস্য লেখক সাবলীলভাবে বলে গেছেন।
◾হৃদয়স্পর্শী কিছু চরণ:
~জীবনের এই যে হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তের প্রতি এমন টান। এ কেন? এই যে ব্যস্ততা,অস্থিরতা,আনন্দ-উচ্ছাস সবই একদিন হারিয়ে যাবে। কেন চিরস্থায়ী হয়না মানুষের আনন্দ? কোথায় ছিলাম কোথায় যাবো? এই বিশাল জলাধির বুকে এই জাহাজে ভর করে।
এতো যাত্রী! লোহালক্করের এই শত শত টন ওজনের জাহাজ কিভাবে ভেসে থাকে পানির ওপর? যেখানে একটা সুঁইও মুহূর্তেই ডুবে যায়। কে সেই মহান সত্তা! অথচ আমরা কতটুকু শুকরিয়া আদায় করি তার?
◾অভিজ্ঞতা অর্জন ও শিক্ষণীয় দিক:
দার্শনিক ভিক্টর হুগোর একটি দারুণ উক্তি সামনে আনতেই হয়। তিনি বলেছিলেন, “পড়তে শেখা মানে আগুন জ্বালানো; বানান করা প্রতিটি শব্দাংশ একটি স্ফূলিঙ্গ।”
সত্যি বলতে কি, “মেরিন ড্রাইভ” বইটি আমার কাছে এমনই একটি বস্তু মনে হয়েছে যা পাঠে আমার পড়ার আগে ও পড়ার পরে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করছিলাম। যেখানে কিছুই জানতাম না বা শুনিনি সে জিনিসগুলো আমি বই পাঠে জানতে ও শিখতে পারলাম। নতুন নতুন বেশ অভিজ্ঞতা ও অর্জন করলাম। প্রকৃতপক্ষে বইটি পাঠে আমি এমন সব ইতিহাস,ঐতিহ্য,স্থাপনা ও নিদর্শন সম্পর্কে জেনেছি যা আমি কখনোই হয়তোবা জানার সুযোগ হতো না যদি না বইটি পড়তাম।
বইটি পড়ে যা শিখেছি ও অর্জন করেছি তা আমার জীবনের জন্য আশীর্বাদ ও এইজন্য লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়।
◾পাঠ-প্রতিক্রিয়া:
একটি ভালো বই হচ্ছে গোটাকয়েক বন্ধুর সমান। একাকিত্ব ও নির্জনে একটা বই হতে পারে শ্রেষ্ঠ মহৌষধ। যা কেবল আপনাকে জ্ঞান রাজ্যে ই প্রবেশ করাবে না বরং আপনার একাকিত্ব ও নির্জনতা দূর করতেও সহায়ক। বইটি পাঠে ক্লান্তি ত দূরে থাক একটি গল্প শেষ করে আরেকটি গল্প না পড়া অব্ধি যেন শান্তি লাগছিল না। বইটির মাঝে এমনসব তথ্য সংযোজন করেছেন লেখক যা প্রতিটি পাঠকের জন্য অনেকটা জ্ঞান অর্জনে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। ভালো-মন্দের মিশেলে সবকিছু। তবে বইটিতে আমি কেবল ভালো দিকটাই বেশিরভাগ দেখলাম। খারাপ বা দৃষ্টিকটু এমনকিছু চোখে পড়েনি বরং লেখক গোটা ভাবনা জুড়ে যেন জাদুর হাতে লিখেছেন শব্দাবলী ও গল্পগুলো। সবমিলিয়ে বইটি পড়ে আমি সার্থক এতটুকু বলতে পারি।
পৃথিবী বইয়ের হউক। সকলে বই পাঠে আগ্রহী হউক। বই হউক একাকিত্বের সঙ্গী।
◾বই-পরিচিতি:
◾বইয়ের নাম: মেরিন ড্রাইভ
◾লেখকের নাম: রেজাউল ইসলাম আজিম
◾বইটির ধরন: গল্পগ্রন্থ
◾প্রকাশনী: উৎসব প্রকাশন
◾প্রকাশক: সাঈদ আহমাদ
◾প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২২
◾প্রচ্ছদ: মিতু
◾মূল্য: ৩০০৳
◾আইএসবিএন: ৯৭৮-৯৮৪-৯১৩৩৪-৪-৩০৳
◾কিনতে পারেন: রকমারী