31-bochor-por

৩১ বছর পর | নুসরাত জান্নাত

ঘোষ পরিবারের ছোট ছেলে বিমল ঘোষ এবার পুজো কাটাতে যাবে কক্সবাজারে। তার স্ত্রী চন্দনাকেও সাথে নিবে। যৌথ পরিবারে থাকা এ দম্পতি পরিবারকে কিছু বলে নি তাদের যাবার ব্যাপারে। যদি সবাই শোনে তবে হাসাহাসি করবে। আসলে তারা যাচ্ছে হানিমুনে। তারা নব দম্পতি নয়। আসছে অক্টোবরে বিয়ের বয়স পেরুবে ৩১ বছর। বিমলের এখন ৫৮ আর চন্দনার ৫১।

এই বয়সে হানিমুন! লোকে শুনলে বলবে কী! ছি!ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে যে!

চন্দনা যখন এই ঘোষ পরিবারে বউ হয়ে আসে তখন তার বয়স ২০ । কতই বা আর বয়স! মেয়েলিপনা এখনো যায় নি। দু চোখ ভরা স্বপ্ন। খুব ইচ্ছে ছিলো বছরে দু’বার না হলে অন্তত একবার স্বামীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাবে। তার নিজের মতো করে বরের সাথে কাটাবে কিছু সময়।

কিন্তু এতো বড়ো পরিবারে এসে তার প্রজাপতির ডানা ভাঙার মতো স্বপ্নগুলো যেনো কুয়োর জলে নিমজ্জিত হলো।

পারিবারিক ব্যবসা মিষ্টি, দই, সন্দেশ, ল্যাংচা, চমচম আরো হরেক রকম মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরিতে সহায়তা করা, অসুস্থ শ্বশুরের সেবা, শ্বাশুড়ির চোখ রাঙানিতে সংসারের সব কাজ করা, তিন জা এর সাথে মানিয়ে চলা এসব এর ভীড়ে কখন যে জীবন থেকে ৩১ বছর হারিয়ে গেছে চন্দনা খেয়াল করেনি। এর মাঝে ৩ ছেলেমেয়ের মা হয়েছে সে। ২ মেয়ের বিয়ে দিয়েছে বেশ বনেদি পরিবারে। ছেলেটারও বিয়ে দিবে এই ফাল্গুনের পরের ফাল্গুনে।

মোটামুটি ঝাড়া হাত পা দুজনের। বিমল অনেক দিন ধরেই সমুদ্র দেখতে যেতে চায়। কিন্তু এই কাজ- সেই কাজ করে করে, টাকার পেছনে ছুটে ছুটে জীবনের প্রায় শেষ বেলায় চলে এসেছে।

যুবাকালে বিমলও বেশ রোমান্টিক প্রেমিক পুরুষ ছিলো। মাথা ভর্তি চুল ছিলো তার। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ সে প্রায় চুল শূন্য। পারিবারিক দোকান ‘ ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার’ এ সময় দেয়াতে তার টাকা যেমন বেড়েছে চুলের পরিমাণ তেমন কমেছে ব্যস্তানুপাতিক হারে। এখন লোকে তাকে ‘টেকো বিমল’ নামেই চেনে।

এই বিমলও চাইতো তার স্ত্রীর সাথে প্রেমময় সময় কাটাতে, দুপুরে দরজা বন্ধ করে একান্তে দুজন এক হয়ে যেতে, মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজতে, গভীর রাতে উঠোনে তার হাত ধরে হাঁটতে।

কিন্তু পারিবারিক চাপ আর কে কখন কী বলে উঠে এই লজ্জামিশ্রিত ভয়ে কখনো ঘরের বাইরে চন্দনার হাত পর্যন্ত ধরতে পারে নি বিমল। সে তার স্ত্রী কে নিয়ে সমুদ্র, পাহাড় এ বেড়াতে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু খুব হিসেবী বিমল টাকার শ্রাদ্ধ হবে ভেবে ইচ্ছেগুলোকে বালিচাপা দিয়ে রেখেছে এই ৩১ বছর।

অবশেষে বিমল ও চন্দনা অনেক জল্পনা-কল্পনার পর পৌঁছে যায় পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। বিশাল এ বালুকাবেলায় এসে রীতিমতো তারা বাকরুদ্ধ। এতো সুন্দর! এতোদিন পর মনে হয় তাদের চোখ বেশ আরাম করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করছে।

শত শত মানুষ ও সমুদ্রের এ বিশাল ঢেউয়ের মিলনমেলা, কোলাহল ও উচ্ছ্বসিত চারিদিক, নবদম্পতি দের জলকেলি, কিছু স্বল্প বসনা নারী ও পুরুষদের বিভিন্ন ভাবে ছবি তোলা সব কিছুই মুগ্ধ করছে বিমল ও চন্দনাকে।

আহ! কী অপূর্ব জলরাশি! কেন যে আরো আগে এলেন না! কেন যে টাকার পেছনে ছুটেছেন চিরকাল! বিশাল বেদনা নিয়ে বিপুল এ জলরাশিকে স্বাক্ষী রেখে তারা নিঃশব্দে একে অপরের দিকে চেয়ে রইলেন। বিমল স্বগোতোক্তি করলেন,

” টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায় কিন্তু যৌবন গেলে আর তা ফিরে পাওয়া যায় না।”

আসলে সময়ের কাছে বড়ো বেশি অসহায় সবাই। অবশেষে ৩১ বছর পর বিমল চন্দনাকে কথা দিলেন যে এরপর থেকে প্রতি বছর তারা বিভিন্ন পর্যটন স্থান গুলোতে ঘুরে আসবেন। তবে শংকার বিষয় এই, জীবনের এ পর্যায়ে এসে সৃষ্টিকর্তা আর কী খুব বেশি সময় দুজনের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন?

Share this article
0
Share
Shareable URL
Prev Post

আনন্দ বেদনার কাব্য | নুসরাত জান্নাত | বুক রিভিউ

Next Post

তারারা সাম্য রাইয়ান সংখ্যা: আলো আঁধারের পদধ্বনি শোনা যাবে | তৈমুর খান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Read next
0
Share