দারাশুকো বেঁচেছিলেন চার দশকের কিছু বেশি সময়। বাদশা শাহজাহানের এই প্রিয়পুত্র তাঁর অতীন্দ্রিয় ভাববাদী জীবন দর্শনের কারণে অসির চেয়ে মসিতেই অধিক আকৃষ্ট ছিলেন। ফলস্বরূপ মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে অবধারিত ভাবে পরাজিত হয়ে করুণ পরিণতি বরণ করেছিলেন। ময়ূর সিংহাসনের দাবিদারদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দারাই সবচেয়ে দুর্বল ছিলেন। পিতার অগাধ সমর্থন শেষ পর্যন্ত তাঁর কোনো কাজেই আসেনি। বরং অত্যধিক পিতৃস্নেহ ও পিতার উপর নির্ভরতা তাঁকে দুর্বল করে দিয়েছিল।
উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে সমদর্শী উদারনৈতিক দারার শোচনীয় পরাজয়ের ফলে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের জন্য মুঘল ভারতের ক্ষমতা মৌলবাদী আওরঙ্গজেবের হাতে চলে যায়। আওরঙ্গজেবের বহু বিতর্কিত শাসনকাল এই উপমহাদেশের উপরে বিশেষত ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে ক্ষতিকর প্রভাব রেখে গেছে, আজও তার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আকবরের আন্তঃধর্মীয় সমন্বয়বাদী প্রচেষ্টার দুর্বল ইমারতটি আওরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতার বলি হয়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে যেমন গান্ধীবাদী নীতির পরাজয় ঘটেছিল সুযোগ সন্ধানী জিন্নার হাতে।
দারাশুকোর ফার্সি অর্থ ‘মহিমান্বিত’। অতীন্দ্রিয়বাদী কবি দারাশুকো, দার্শনিক লেখক দারাশুকো, বেদান্তবাদী দারাশুকো, সূফি চিন্তক দারাশুকো – সর্বোপরি মানুষ দারাশুকো তাঁর ক্ষুদ্র জীবনকে নানা রচনার মাধ্যমে বৃহৎভাবে মহিমান্বিত করে গেছেন। মধ্যকালীন ভারতের মুঘল যুগে পরমতসহিষ্ণু উদারনৈতিক দারাশুকোর প্রগতিপন্থী চিন্তা ভাবনা সত্যিই বিস্ময়কর। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যা সহজ সাবলীল, মধ্যযুগে তা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই অসম্ভবতার কালে দাঁড়িয়ে মুঘল রাজবংশের দু’জন মানুষ আকবর ও দারাশুকো যে ব্যতিক্রমী চিন্তা চেতনার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা অভাবনীয় ঘটনা। সহিষ্ণুতার চিন্তাধারায় দারাশুকো তাঁর প্রপিতামহের উত্তরসূরি ছিলেন। এর সাথে যদি সামরিক প্রতিভা যুক্ত হতো, তাহলে ভারত ইতিহাসের গতি প্রকৃতি বদলে যেত।
দারাশুকো সৈন্য শিবিরের চেয়ে সাধু-সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ, সন্ত-দার্শনিকদের সান্নিধ্যে থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। অতীন্দ্রিয়বাদীতা তাঁকে ময়ূর সিংহাসনের স্বপ্ন থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দারা মুঘল আভিজাত্যের মধ্যে থেকেও নিজের একটি স্বতন্ত্র জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলেন। ভাববাদীতার সেই জগতে বাস্তববাদীতার স্থান ছিল সংকুচিত। রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ সেখানে দার্শনিকতার অন্তরালে ঢাকা পড়েছিল। এই রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে আগ্রার অদূরে সামুগড়ের যুদ্ধ প্রান্তরে দারার সেই স্বপ্নপ্রবণতার সমাধি রচিত হয়েছিল।
দারাশুকো ও তাঁর বড়বোন জাহানারা ছিলেন লাহোরের সূফি সন্ত মিয়াঁমীরের শিষ্য। দারা কাদেরিয়া সিলসিলার অনুগামী ছিলেন। এছাড়া সাধু সারমাদ ও হিন্দু যোগী বাবালালের শিষ্য ছিলেন তিনি। এঁদের অতীন্দ্রিয়বাদী চিন্তাধারার প্রভাবে দারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। দারা বিভিন্ন ধর্মের সার সত্য ও আন্তঃধর্মীয় মিলন সূত্রের বিষয়ে জানতে আগ্রহী ছিলেন। হিন্দু বেদান্তবাদ ও ইসলামীয় সূফিবাদ নিয়ে চর্চার ফলে দারা ভারতবর্ষের এই প্রধান দুটি ধর্মের মধ্যে ঐক্যের ও মিলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে দারা রচনা করেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটি। “দুই সাগরের সম্মিলন” – নামক গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক দারা তাঁর বৃহৎ উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বিরোধপূর্ণ দুই সাগর – হিন্দু ও ইসলাম এর মধ্যে মিলন ও সংহতির বিষয়ে দারা প্রবল আশাবাদী ছিলেন। যদিও তা দুরাশায় পর্যবসিত হয়েছিল।
সূফি চিন্তক দারা রচনা করেছিলেন পয়গম্বর থেকে মিয়াঁমীর পর্যন্ত তিন শতাধিক সূফি সাধকের জীবনী। বেদান্তবাদী দারা পঞ্চাশটি প্রধান উপনিষদের ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করে তাঁর বেদান্তচর্চার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দারার অনুবাদিত এই ফার্সি উপনিষদ প্রথম ইউরোপে পৌঁছেছিল। পরোক্ষ ভাবে দারার মাধ্যমেই ইউরোপীয় চিন্তাজগৎ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের সাথে পরিচিত হয়েছিল। জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ার মুগ্ধ চিত্তে এ বিষয়ে তাঁর অনুভূতি লিখে গেছেন। উপনিষদের সার গীতার ফার্সি অনুবাদ দারার জীবনের শেষদিকের অন্যতম এক রচনাকর্ম। দিল্লীর লালকেল্লার অদূরে নিগমবোধ মঞ্জিল নামক দারার নিজস্ব বাসস্থান ও চর্চাকেন্দ্রে বসে তিনি বেদান্ত অধ্যয়ন করতেন। উপনিষদ ও গীতার ফার্সি অনুবাদ এখানেই রচিত হয়েছিল।
পরমতসহিষ্ণুতা, সাধুসঙ্গ ও হিন্দু গ্রন্থের অনুবাদের কারণে দারাশুকো তাঁর ছোটভাই আওরঙ্গজেবের দৃষ্টিতে ছিলেন এক ধর্মদ্রোহী। তাই তিনি দারার শিরচ্ছেদের আদেশ দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁর অনুগামীদের কাছে ছিলেন (এবং এখনো আছেন) জিন্দাপীর। তাঁর সমাধি মহান কোনো সন্তের সমাধির মতোই সম্মানিত স্থান। অন্যদিকে দারার প্রকৃত সমাধিটি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। আজও আওরঙ্গজেবের পক্ষে বিপক্ষে যে চর্চার ধারা দেখা যায়, আকবর কিংবা দারাশুকোর সেখানে কোনো স্থান নেই। আজকের ইতিহাস চর্চায় আকবর ও দারাশুকো তেমন আলোচিত নন। তারা যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। আওরঙ্গজেবের চিন্তাধারা চর্চা ভারতীয় উপমহাদেশকে শুধুমাত্র অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দারাশুকোর জীবনদর্শনের চর্চা আমাদেরকে আশার আলো দেখাতে পারে। তাই আকবর ও দারাশুকো চর্চা জরুরি।
তথ্যসূত্র:
- শাহজাদা দারাশুকো – কালিকারঞ্জন কানুনগো,
- কুমার দারার বেদান্তচর্চা – যদুনাথ সরকার (যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার),
- সাংস্কৃতিকী চতুর্থ খণ্ড – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,
- শাহজাদা দারাশুকো – শানজিদ অর্ণব।
- উইকিপিডিয়া